Ad_vid_720X90 (1)
Advertisment
মনমোহন সিংহ: ভারতীয় অর্থনীতির রূপকারের প্রয়াণ

প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ প্রয়াত: ভারতের অর্থনৈতিক সংস্কারের রূপকারের চিরবিদায়

নয়াদিল্লি: ভারতের গণতান্ত্রিক কাঠামো ও যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় গভীর বিশ্বাসী ছিলেন মনমোহন সিংহ। তাঁর আশা ছিল, ভবিষ্যতে ইতিহাস তাঁর প্রতি ন্যায়বিচার করবে। কিন্তু সেই ইতিহাসের সাক্ষী হওয়ার আগেই চিরতরে বিদায় নিলেন দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ৯২ বছর বয়সে দিল্লির AIIMS হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। হঠাৎ শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় দ্রুত তাঁকে হাসপাতালে আনা হলেও শেষরক্ষা হয়নি।

AIIMS সূত্রে জানানো হয়েছে, বার্ধক্যজনিত কারণে গত কয়েক মাস ধরে তাঁর চিকিৎসা চলছিল। ২৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় আচমকা অজ্ঞান হয়ে পড়েন। রাত ৮টা ৬ মিনিটে হাসপাতালে ভর্তি করার কিছু পরেই তাঁর শ্বাসকষ্ট গুরুতর আকার ধারণ করে। রাত ৯টা ৫১ মিনিটে চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।

এদিন কংগ্রেস নেত্রী সনিয়া গান্ধী, প্রিয়াঙ্কা গান্ধী, মল্লিকার্জুন খাড়গে এবং বিজেপি সভাপতি জেপি নাড্ডা AIIMS-এ উপস্থিত হন। রাহুল গান্ধী বেলগাভিতে দলীয় কর্মসূচিতে থাকলেও শোকবার্তা জানিয়ে দিল্লি ফেরার কথা জানান। তাঁর প্রয়াণের খবরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি থেকে শুরু করে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যপাধ্যায় শোক জ্ঞাপন করেন।

প্রধানমন্ত্রী এক্স হ্যান্ডেলে লেখেন, “দেশের একজন বিশিষ্ট নেতা ছিলেন ডঃ মনমোহন সিংজি। তিনি একজন প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ হয়ে ওঠেন এবং কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী-সহ সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। আমাদের অর্থনীতিতে তাঁর অবদান চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে। সংসদে তাঁর কার্যকলাপ দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিল। তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মানুষের জীবনে উন্নয়ন আনতে যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলেন।”

প্রধানমন্ত্রী আরও স্মরণ করেন, “আমি যখন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী ছিলাম, তখন প্রায়ই প্রশাসনিক বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা হত। তাঁর জ্ঞান এবং নম্রতা আমাকে মুগ্ধ করত। এই শোকের সময় ডঃ মনমোহন সিংজির পরিবার, বন্ধু এবং অগণিত ভক্তদের প্রতি আমার সমবেদনা জানাই। ওম শান্তি।”

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় লেখেন, “আমাদের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংজির আকস্মিক মৃত্যুতে আমি হতবাক এবং শোকাচ্ছন্ন। আমি তাঁর সঙ্গে কাজ করেছি এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় তাঁকে কাছ থেকে দেখেছি। তাঁর প্রশ্নাতীত পাণ্ডিত্য এবং দেশের অর্থনৈতিক সংস্কারে তাঁর গভীরতা সর্বত্র সমাদৃত। তাঁর নেতৃত্বের অভাব বোধ করবে এই দেশ। আমি তাঁর স্নেহ থেকে বঞ্চিত হলাম।”

তিনি আরও বলেন, “তাঁর পরিবার, বন্ধু এবং অনুগামীদের প্রতি আমার আন্তরিক সমবেদনা রইল।”

এক উজ্জ্বল জীবনের যাত্রা

১৯৩২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর অবিভক্ত পাঞ্জাবের গাহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মনমোহন সিংহ। তাঁর জন্ম এক শিখ পরিবারে। ছোটবেলায় মাকে হারানোর পর ঠাকুমার কাছে মানুষ হন। দেশভাগের সময় পরিবারের সঙ্গে পাঞ্জাবের অমৃতসরে চলে আসেন। পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটি থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।

এরপর কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করে নজির সৃষ্টি করেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে DPhil সম্পন্ন করার পর দেশে ফিরে দীর্ঘ সময় অধ্যাপনা করেন। ১৯৮২ সালে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার গভর্নর পদে নিযুক্ত হন।

অর্থনৈতিক সংস্কারের পথিকৃৎ

১৯৯১ সালে অর্থমন্ত্রী হিসেবে মনমোহন সিংহ দেশের অর্থনীতিতে ঐতিহাসিক সংস্কার আনেন। রাজস্ব ঘাটতি ও বৈদেশিক মুদ্রার সংকট মোকাবিলায় তিনি ভারতকে মুক্ত অর্থনীতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যান। বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং বেসরকারিকরণের মাধ্যমে ভারতের অর্থনীতিকে মজবুত ভিত্তি প্রদান করেন।

প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ২০০৭ সালে তাঁর নেতৃত্বে ভারতের GDP বৃদ্ধি পেয়ে ৯ শতাংশে পৌঁছায়। তাঁর উদ্যোগে ভারত পৃথিবীর দ্বিতীয় দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতিতে পরিণত হয়।

ব্যক্তিগত জীবন ও ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত

১৯৫৮ সালে গুরশরণ কৌরের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন মনমোহন। তাঁদের তিন মেয়ে রয়েছে—উপিন্দর, দামন এবং অমৃত। তাঁর নেতৃত্বে দেশে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সংস্কার হয়।

১৯৮৪ সালের শিখ দাঙ্গার জন্য কংগ্রেসের পক্ষ থেকে ক্ষমা চেয়ে রাজনৈতিক শালীনতার উদাহরণ স্থাপন করেন তিনি। যদিও বিরোধীরা তাঁকে “মৌনমোহন” বলে কটাক্ষ করত, তিনি বরাবর তাঁর কাজের মাধ্যমেই সমালোচনার জবাব দিয়েছেন।

মনমোহনের ঐতিহ্য

তাঁর নেতৃত্বে ভারত বিশ্বমঞ্চে অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। তিনি ছিলেন একজন স্বল্পভাষী, কিন্তু তাঁর কাজই ছিল তাঁর শক্তি। ইতিহাসে মনমোহন সিংহকে ভারতের অর্থনৈতিক রূপান্তরের রূপকার হিসেবে মনে রাখা হবে।

Facebook
Twitter
WhatsApp
Telegram
Email
Print
error: Content is protected !!