ঝুলনযাত্রার পূর্ণাঙ্গ বিবরণ: বাংলার ঐতিহ্যবাহী উৎসব

ঝুলনযাত্রারপূর্ণাঙ্গবিবরণ: বাংলার ঐতিহ্যবাহী উৎসব

ঝুলন যাত্রার উৎসবের অর্থ

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভক্তদের প্রতি তাঁর অনুগ্রহ প্রদর্শন করার জন্য গোলকধাম থেকে পৃথিবীতে এসে লীলা করেন। এই প্রেমলীলাই ঝুলন যাত্রা। ঝুলন পূর্ণিমাকে শ্রাবণী পূর্ণিমা বলা হয়। এটি একাদশী থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত পাঁচদিন ধরে পালিত হয় এবং এর মাধ্যমে বৃন্দাবনের শৈশবের স্মৃতির পূর্ণ প্রকাশ ঘটে।

পশ্চিমবঙ্গের ঝুলন যাত্রার উৎসব

ঝুলন যাত্রা পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় পালিত হলেও, নবদ্বীপ ও বিশেষ করে মায়াপুরে এর আয়োজন বিশেষভাবে হয়ে থাকে। কৃষ্ণের বাল্যকাল থেকে কিশোর বয়স পর্যন্ত নানা কার্যকলাপ পুতুল দিয়ে সাজানো হয়ে থাকে, যা ঝুলনের আকর্ষণের অন্যতম অংশ। ভক্তদের বিশ্বাস, ঝুলন যাত্রায় রাধা-কৃষ্ণকে দোলনায় দোলালে কৃষ্ণ বেশ আনন্দিত হন। পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার শান্তিপুর, বরানগরের পাঠবাড়ি আশ্রম, এবং বউবাজারের রামকানাই অধিকারীর ঝুলনবাড়িতে ঝুলন যাত্রার উৎসব দেখতে বহু দর্শক আসেন।

ঝুলন যাত্রার ইতিহাস

হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দ্বাপরযুগে পৃথিবীতে আবির্ভূত হন। নন্দের বাড়িতে থাকার সময় এবং বৃন্দাবনে তিনি বিভিন্ন লীলা করেন। কিশোর বয়সে কৃষ্ণ ও রাধার প্রেমের পূর্ণ প্রকাশ বৃন্দাবনে ঘটেছিল, তাই ঝুলন যাত্রার উৎসবের মূল কেন্দ্র বৃন্দাবন।

ঝুলন যাত্রার কাহিনী

একবার ব্রজের গোপীরা রাধাকুঞ্জের পাশে কুঞ্জবনে এসেছিলেন। সেখানে তাঁরা রাধা ও কৃষ্ণকে দোলনা খেলানোর জন্য জড় হয়েছিলেন। কৃষ্ণ তাঁর মনের মাধুরী দিয়ে রাধাকে সাজিয়েছিলেন কৃষ্ণের বেশে, এবং রাধার হাতে বাঁশি দিয়েছিলেন। গোপীরা দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন, কারণ তাঁরা সেখানে দু’জন কৃষ্ণ দেখতে পাচ্ছিলেন। তাঁরা রাধাকে না-পেয়ে নানা পরীক্ষার পর কৃষ্ণকেই রাধা মনে করেছিলেন। কৃষ্ণ রাধার কণ্ঠে জবাব দিয়েছিলেন যে মন্ত্রপূত জল ফেলে তিনি এমন পুরুষালি চেহারা করেছেন, আসলে তিনি রাধা। গোপীরা পরবর্তীতে কৃষ্ণের ছলনা ধরতে সক্ষম হন এবং কৃষ্ণকে রাধারূপী চেহারা ফিরিয়ে দিতে অনুনয় করেন।

ঝুলনে বিশেষ আচার

ঝুলনে রাধা-কৃষ্ণের মূর্তি ঝুলনায় রেখে পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে দোল খাওয়ানোর রীতি অনুসরণ করা হয়। বৈষ্ণব শাস্ত্রমতে, সূর্য পূর্ব দিকে উদয় ও পশ্চিম দিকে অস্ত হয়, তাই ঝুলন উৎসবে রাধা-কৃষ্ণকে দোলানোও পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে হয়। বৈষ্ণব ধর্মে, কৃষ্ণকে লাভ করার জন্য রাধার উপাসনা আবশ্যক। রাধার কৃপা থাকলে কৃষ্ণ সহজেই লাভ করা যায় এবং রাধার শক্তিতে কৃষ্ণ শক্তিশালী হন।

পুজোর নিয়ম

ঝুলন যাত্রার দিনে শ্রীকৃষ্ণকে হলুদ রঙের বস্ত্র পরানো হয়। এছাড়া হলুদ মিষ্টি, হলুদ রঙের ফল ও ফুল নিবেদন করা হয়। ময়ূরের পালক কিনে এনে ঠাকুরের পাশে রাখা হয় এবং চন্দন কাঠ রাখলে বাড়ির অশুভ শক্তি দূর হয়। এছাড়া বাড়িতে এদিন বীণা কিনলেও পজিটিভিটি বজায় থাকে।

বৃন্দাবনে ঝুলন যাত্রা

বৃন্দাবনে ঝুলন যাত্রার উৎসব ব্যাপকভাবে পালিত হয়। এখানকার শ্রী রাধারমণ মন্দিরের সঙ্গে সপ্ত দেবালয়ের অন্তর্ভুক্ত মন্দির রয়েছে। ঝুলন মহোৎসবে প্রতি তৃতীয় দিনে দেবতাকে আলাদা দোলনায় বসানো হয়। এই দিনগুলিতে ঈশ্বরের বহু অলৌকিক শোভা দেখা যায়। বৃন্দাবনের শ্রী রূপ-সনাতন গৌড়ীয় মঠ, বাঁকে বিহারী মন্দির, মথুরার দ্বারকাধীশ মন্দির, জগন্নাথ পুরীর গৌড়ীয় মঠ, ইসকন মন্দির ইত্যাদি স্থানেও ঝুলন যাত্রা বড় জাঁকজমকের সঙ্গে পালিত হয়।

ঝুলন পূর্ণিমা ২০২৪

এবছর ঝুলন পূর্ণিমা একাদশী তিথি ৩০ শ্রাবণ, বৃহস্পতিবার অর্থাৎ ১৫ আগস্ট সকাল ১০টা ২৮ মিনিটে শুরু হবে এবং ৩১ শ্রাবণ, শুক্রবার অর্থাৎ ১৬ আগস্ট সকাল ৯টা ৪০ মিনিটে শেষ হবে। পূর্ণিমা তিথি ২ ভাদ্র, রবিবার বা সোমবার ভোররাতে ইংরেজি ১৮ আগস্ট রাত ৩টে ৬ মিনিটে পড়বে এবং ৩ ভাদ্র, সোমবার রাত ১১টা ৫৬ মিনিটে শেষ হবে। এই সময়ে শ্রীকৃষ্ণের ঝুলনযাত্রা শেষ হবে।

Facebook
Twitter
WhatsApp
Telegram
Email
Print
আরও পড়ুন
error: Content is protected !!