শক্তি ও সূর্যের আরাধনায় ছট পূজার গুরুত্ব এবং ছটী মাইয়ার ভূমিকা
ছট পূজা হিন্দুধর্মে এক বিশেষ ধর্মীয় উৎসব, যা সূর্যদেব ও ছটী মাইয়ার প্রতি নিবেদিত। সূর্যকে একমাত্র দৃশ্যমান দেবতা হিসেবে পূজা করা হয় কারণ তিনি পৃথিবীর সকল প্রাণীর জীবনদাতা। ছট পূজায় সূর্যদেবের পাশাপাশি ছটী মাইয়ারও পূজা করা হয়। বৈদিক জ্যোতিষ শাস্ত্রে ছটী মাইয়াকে সন্তানদের রক্ষা ও তাদের দীর্ঘায়ু প্রদানের দেবী হিসেবে মান্য করা হয়। বিহার ও ঝাড়খণ্ডের স্থানীয় ভাষায় ‘ছটী মাইয়া’ হলেন দেবী ষষ্ঠী, যিনি সন্তানদের সুরক্ষাদাত্রী।

ছট পূজার উৎসব
ছট পূজা একটি চারদিনের লোক উৎসব যা কার্তিক শুক্ল চতুর্থী থেকে শুরু হয়ে কার্তিক শুক্ল সপ্তমীতে শেষ হয়।
নাহায় খায় (প্রথম দিন)
এই দিনটি পূজার সূচনা হিসেবে পরিচিত। স্নানের পর বাড়ি পরিষ্কার করে নিরামিষ খাবার গ্রহণ করা হয় যাতে মনকে পবিত্র ও শান্ত রাখা যায়।
খরনা (দ্বিতীয় দিন)
দ্বিতীয় দিনে উপবাস রাখা হয় এবং এদিন জলপান পর্যন্ত নিষিদ্ধ থাকে। সন্ধ্যায় গুড়ের ক্ষীর, ফল এবং ঘিতে ভাজা রুটি খাওয়া হয়।
সন্ধ্যা অর্ঘ্য (তৃতীয় দিন)
তৃতীয় দিনে সূর্যদেবকে সন্ধ্যায় অর্ঘ্য নিবেদন করা হয়। বাঁশের ডালায় ফল, থেওকা এবং চালের লাড্ডু সাজিয়ে অর্ঘ্য প্রদান করা হয়। সূর্যদেব ও ছটী মাইয়াকে জল ও দুধ দিয়ে পূজা করা হয়, এরপর রাতভর দেবীর কীর্তন ও ব্রতকথা পাঠ করা হয়।
ঊষা অর্ঘ্য (চতুর্থ দিন)
শেষ দিনে সূর্যোদয়ের আগে নদীর তীরে গিয়ে সূর্যদেবকে অর্ঘ্য নিবেদন করা হয়। এই দিন ছটী মাইয়ার কাছে সন্তানদের সুরক্ষা এবং পরিবারের শান্তি কামনা করা হয়। অর্ঘ্যের পর শারবত ও কাঁচা দুধ পান করে এবং প্রসাদ গ্রহণ করে উপবাস ভাঙা হয়, যা ‘পারান’ নামে পরিচিত।
ছট পূজার প্রয়োজনীয় সামগ্রী
ছট পূজার জন্য পূর্বেই কিছু সামগ্রী প্রস্তুত করতে হয়:
- বাঁশের তিনটি বড় ডালা, তিনটি শূপ বা বাঁশ ও পিতলের থালা, দুধ এবং গ্লাস
- চাল, সিঁদুর, প্রদীপ, নারকেল, হলুদ, আখ, সুটানি, মিষ্টি আলু
- নাশপাতি, বড় লেবু, মধু, পান, গোটা হারদ, কর্পূর, চন্দন ও মিষ্টান্ন
- প্রসাদ হিসেবে থেওকা, মালপোয়া, ক্ষীর-পুরি, সুজির হালুয়া, চালের লাড্ডু ইত্যাদি।
ছট পূজার অর্ঘ্য প্রদানের পদ্ধতি
উপরোক্ত পূজার সামগ্রী বাঁশের ডালায় সাজানো হয় এবং প্রদীপ প্রজ্বলন করে শূপে রাখা হয়। নারীরা কোমর-জলে দাঁড়িয়ে হাতে শূপ নিয়ে সূর্যদেবকে অর্ঘ্য নিবেদন করেন।

ছট পূজা সম্পর্কিত কিংবদন্তি
ব্রহ্মা বৈবর্ত পুরাণে ছট পূজার উল্লেখ রয়েছে। একটি কিংবদন্তি অনুযায়ী, রাজা প্রিয়ব্রত ও রানী মালিনী একবার সন্তান না থাকার জন্য দুঃখী ছিলেন। মহর্ষি কাশ্যপের নির্দেশে তাঁরা যজ্ঞ করলে সন্তান জন্মগ্রহণ করে কিন্তু সে শিশুটি মৃত অবস্থায় জন্মায়। তখন আকাশ থেকে দেবী ষষ্ঠী আবির্ভূত হন এবং শিশুটিকে জীবিত করেন। এর পর থেকে রাজা প্রিয়ব্রত দেবী ষষ্ঠীর পূজা করেন, এবং তার পর থেকেই ছট পূজা প্রচলিত হয়।
ছট পূজার ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব
ছট পূজা হিন্দু ধর্মে সূর্যদেবের একমাত্র পূজা যেখানে সূর্যকে সরাসরি অর্ঘ্য নিবেদন করা হয়। সূর্যের আলো জীবাণু ধ্বংস করতে সক্ষম এবং মানুষের স্বাস্থ্য, ধন-সম্পদ ও আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করে। বৈদিক শাস্ত্রে সূর্য আত্মা, পিতা এবং পূর্বপুরুষের প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচিত। এছাড়া, ছট পূজায় সরলতা, পবিত্রতা এবং প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়।
জ্যোতিষ শাস্ত্রে ছট পূজার গুরুত্ব
বৈজ্ঞানিক এবং জ্যোতিষশাস্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে ছট পূজার বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। কার্তিক শুক্ল পক্ষের ষষ্ঠী তিথি সূর্যের দক্ষিণায়নে অবস্থিতির সময় হয়। এই সময় সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মির প্রবাহ বৃদ্ধি পায় যা চোখ, পেট এবং ত্বকে প্রভাব ফেলে। ছট পূজায় সূর্যের পূজা করলে এই ক্ষতিকর রশ্মির প্রভাব কম হয়, তাই এই পূজার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।
এইভাবে ছট পূজা, সূর্যদেব এবং ছটী মাইয়ার পূজা দ্বারা সন্তানদের সুখ, দীর্ঘায়ু এবং পরিবারে শান্তি প্রার্থনা করা হয়।