২৪শে জুলাই ১৯৮০, ৮ই শ্রাবণ ১৩৮৭ — বৃহস্পতিবার
৪৫ বছর পর—২০২৫ সালের ২৪শে জুলাইও বৃহস্পতিবার, ৭ই শ্রাবণ ১৪৩২, যেন ফিরে এলো সেই শোকাবহ দিন…
এই দিনটা স্রেফ একটা ক্যালেন্ডারের তারিখ নয়। এই তারিখের গায়ে লেগে আছে অভিমান, নীরব হাহাকার আর এক ফুরিয়ে যাওয়া যুগের দীর্ঘশ্বাস। ১৯৮০ সালের এই দিনেই নিভে গিয়েছিল এক নক্ষত্রের আলো — চলে গিয়েছিলেন মহানায়ক উত্তমকুমার।

তিনি শুধুই এক ‘নায়ক’ ছিলেন না। ছিলেন এক পর্ব, এক অধ্যায়, এক আবেগের নাম। তাঁর চোখে যেমন ছিল মুগ্ধ করার নিপুণতা, তেমনই তাঁর মৌনতা ছিল কবিতার মতো। তিনি ছিলেন রূপালি পর্দার চেনা ম্যাজিক, যাঁর শীতল অথচ উদ্দীপ্ত অভিব্যক্তি আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছিল—‘স্টারডম’ শব্দটা কতটা আত্মিক হতে পারে।

আজও তাঁর সিনেমা চালিয়ে দিলে, অজান্তে নিঃশব্দ হয়ে যায় ঘর। কথোপকথনের বদলে ঘিরে ফেলে শ্বাসরুদ্ধ স্তব্ধতা। মুখে কোনো কথা থাকে না, শুধু চোখে জল টলমল করে ওঠে। “আমি তোমায় ভালোবাসি”—উচ্চারণটা কতবার বলা হয়েছে বাংলা সিনেমায়, কিন্তু উত্তমের ঠোঁট থেকে বেরোনো ওই শব্দগুলো এখনও সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য শোনায়।

শেষ শুটিংয়ের দিন, চুরি যাওয়া এক প্রিয় সঙ্গী
১৯৮০ সালের ২৩শে জুলাই—মহানায়কের মৃত্যুর ঠিক ২৪ ঘণ্টা আগে।
মামলা-মোকাদ্দমায় জর্জরিত, জনপ্রিয়তায় ভাটা, ইন্ডাস্ট্রি থেকেও বিমুখতা। অনেক পরিচালক এড়িয়ে চলছিলেন তাঁকে। মুখে কিছু বলতেন না, কিন্তু হাবভাবেই বুঝিয়ে দিতেন। উত্তমকুমারও তা বুঝতেন।

এদিকে হাসপাতালে ভর্তি সুপ্রিয়া দেবী। তাতে মন আরও ভারাক্রান্ত। তবু নিয়ম করে শুটিং চালিয়ে যাচ্ছেন। ২৩ জুলাই ছিল তেমনই এক দিন।
সকালে স্নান সেরে পুজো-অর্চনা করে বেরচ্ছেন শুটিংয়ে। প্রতিদিন বেরনোর সময় দরজার সামনে থাকতেন সুপ্রিয়া দেবী—আজ সেই দুয়ার শূন্য। পিছন ফিরে উত্তম তাকিয়ে দেখলেন, তাঁর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে নেই বেণু।

গৌরীর সঙ্গে মন কষাকষির পর, এক কাপড়ে এই ময়রা স্ট্রিটের বাড়ির দরজায় যখন বিধ্বস্ত উত্তম দাঁড়ান, দ্বিধাহীনভাবে আশ্রয় দিয়েছিলেন সুপ্রিয়া। সেদিন বিস্ময়-মমতা দুই নিয়ে হাসিমুখে দরজা উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন তিনি। সেখানেই শুরু হয়েছিল তাঁদের একসঙ্গে পথচলা—সতেরো বছর ধরে।

সেদিন, বেরোনোর সময় উত্তমকুমার মনেই মনে ভাবছিলেন—”আমায় ওর অন্তরের সবটুকু দিয়ে ভালোবাসে, আমি জানি না, পরলোকের ডাকে সাড়া দিয়ে কে আগে যাবে—আমি না বেণু!”
ঠিক তখনই জীবনে ঘটে এক আকস্মিক ঘটনা। গাড়িতে উঠতে গিয়ে দেখেন তাঁর প্রিয় টেপ রেকর্ডারটি নেই! প্রযোজক অসীম সরকারও হতবাক। খোঁজ শুরু হলো—শেষে বোঝা গেল সেটি চুরি হয়েছে।

এই টেপ রেকর্ডারটি ছিল তাঁর সবচেয়ে ব্যক্তিগত সঙ্গী। প্রতিদিনের শুটিংয়ের আগে সেটির মাধ্যমে নিজেকে প্রস্তুত করতেন। অনেক স্মৃতি জড়ানো ছিল তাতে। সেই যন্ত্রটির হারানো যেন আগাম এক বার্তাই দিয়ে দিয়েছিল—শেষের শুরু।
“আমিও দেখে নেবো, আমার নাম গগন সেন…” – জীবনের শেষ সংলাপ
মনখারাপ নিয়ে সেদিনও তিনি পৌঁছে গিয়েছিলেন ‘ওগো বধূ সুন্দরী’র ফ্লোরে। অন্যমনস্ক ছিলেন। কিছু খাননি। অথচ কেউ ভাবেনি এটাই হবে তাঁর জীবনের শেষ শুটিং।
শেষ সংলাপটি ছিল—
“আমিও দেখে নেবো, আমার নাম গগন সেন…”
এই সংলাপ বলতে বলতেই অসুস্থ হয়ে পড়েন মহানায়ক।
বাড়িতে ফিরে গিয়েও বিছানায় পড়ে থাকেননি। বন্ধুর অনুরোধে রাতের আড্ডায় গিয়েছিলেন। হাসিমুখে ছিলেন। কিন্তু মাঝরাতে ফিরে এসে ফের অসুস্থ হয়ে পড়েন। ভর্তি করা হয় বেসরকারি নার্সিং হোমে।
ডাক্তারের নিরলস চেষ্টাও শেষরক্ষা করতে পারেনি।

বিদায় মহানায়ক…
২৪শে জুলাই, ১৯৮০ | রাত ৮টা ৩২ মিনিট
জীবনের রঙ্গমঞ্চ ছেড়ে চিরবিদায় নেন উত্তমকুমার।
ডাক্তারদের কাছে নিজেকে বাঁচানোর অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু থেমে গিয়েছিল হৃদস্পন্দন। নার্সিং হোম থেকে দেহ নিয়ে যাওয়া হয় গিরিশ মুখার্জি রোডের বাড়িতে।
খবর ছড়িয়ে পড়তেই মহানগর ভেসে যায় আবেগের জলোচ্ছ্বাসে। জনতার ঢল। শ্মশানের পথে মিছিল।
পুলিশ ব্যারিকেড ভেঙে ফেলে উত্তেজিত জনতা।
পরপর কয়েকটি স্টুডিওতে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁর মরদেহ। চোখের জলে বাবাকে বিদায় জানান পুত্র গৌতম।
অনেকে বলেন, এটাই ছিল সেই মুহূর্ত—যখন প্রথমবার ছেলের চোখে জল দেখেছিলেন তাঁরা।

শোকাবিষ্ট টলিউড, শেষ শ্রদ্ধা…
সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন,
“উত্তমের মতো কোনও নায়ক নেই। কেউ হবেও না। আশ্চর্য অভিনয়ের ক্ষমতা ছিল ওর।”
সুচিত্রা সেন বলেছিলেন,
“ও গ্রেট… কিন্তু ওকে ঠিক মতো আবিষ্কার করা গেল না।”
সেই দিনেই তাঁর বাড়িতে ছুটে আসেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, বসন্ত চৌধুরী, রঞ্জিত মল্লিক, সত্য মুখোপাধ্যায়, দীপঙ্কর দে সহ অগণিত তারকা। উত্তম ছিলেন শিল্পীদের শিল্পী, দর্শকদের দেবতা।

আজও উত্তম অমর
আজ এতগুলো বছর কেটে গেছে। বাংলা সিনেমা অনেক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গেছে। কিন্তু উত্তমকুমার রয়েছেন—চোখে, মনে, স্মৃতিতে, শিরায়।
আজও যখন ‘ছায়া’ ছবি ভেসে ওঠে পর্দায়, মন বলে—এই তো, তিনি আছেন, আমাদের মধ্যেই…🙏