পরিচালক, নাট্যকার, অভিনেতা ও লেখক—ঋত্বিক কুমার ঘটক ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের এক মহান বিপ্লবী। তাঁর সিনেমা শুধু বিনোদনের জন্য নয়; তা ছিল সমাজের বাস্তবতা ও মানবিক বেদনাকে ফুটিয়ে তোলার এক শক্তিশালী মাধ্যম। সত্যজিৎ রায় ও মৃণাল সেনের সঙ্গে তুলনীয় হলেও, ঋত্বিক ঘটকের সিনেমায় দেশভাগের যন্ত্রণা, রাজনৈতিক আন্দোলন ও শোষিত মানুষের আর্তনাদ গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। আজও তাঁর সৃষ্টি দর্শকদের মনে অমলিন।
ঋত্বিক ঘটকের সিনেমা শুধুমাত্র গল্প বলা নয়, বরং তার মধ্যে লুকিয়ে থাকে গভীর রাজনৈতিক ও সামাজিক বার্তা। তিনি ছিলেন এক চিরবিদ্রোহী শিল্পী, যিনি কখনোই আপস করেননি। দেশভাগের যন্ত্রণা, উদ্বাস্তু জীবন, শোষণ, বিচ্ছিন্নতার কষ্ট—এসব তাঁর সিনেমার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছিল।
তাঁর ছবিগুলো যেন সমাজের প্রতি এক চপেটাঘাত—কখনও সরাসরি, কখনও রূপকের মাধ্যমে। ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘কোমল গান্ধার’, ‘সুবর্ণরেখা’—এই ছবিগুলো শুধু চলচ্চিত্র নয়, বরং একেকটি প্রতিবাদের ভাষা।

👉 “তুমি গেছো, স্পর্ধাও গেছে, বিনয় এসেছে।”
এই সংলাপের মধ্যেও সেই অন্তর্দ্বন্দ্ব স্পষ্ট—যেখানে হারিয়ে যায় এক প্রজন্মের অহংকার, প্রতিবাদ, আত্মসম্মান, আর পরিবর্তে আসে বিনয়ের আড়ালে আত্মসমর্পণ।
ঋত্বিক ঘটকের সিনেমা আজও নতুন প্রজন্মকে ভাবিয়ে তোলে, নতুন করে চিন্তা করতে শেখায়। তাঁর সিনেমা শুধু বিনোদন নয়, বরং এক চিরকালীন সত্যের দর্পণ। 🎥✨
ঋত্বিক ঘটকের জীবনী
প্রাথমিক জীবন ও শিক্ষা
১৯২৫ সালের ৪ নভেম্বর অবিভক্ত ভারতের পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশের) রাজশাহীর মিয়াঁপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন ঋত্বিক ঘটক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রাজশাহীতে ফিরে এলেও দেশভাগের পর পরিবারসহ কলকাতায় চলে যান। ছোটবেলা থেকেই সাহিত্য, নাটক ও রাজনীতির প্রতি ঝোঁক ছিল তাঁর।
ময়মনসিংহের মিশন স্কুল ও কলকাতার বালিগঞ্জ স্কুলে পড়াশোনা শেষে বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। এমএ কোর্স শুরু করলেও লেখালেখির প্রতি গভীর আকর্ষণ থাকায় তা শেষ করেননি।

চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ
১৯৫০ সালে পরিচালক নিমাই ঘোষের সিনেমা ‘ছিন্নমূল’-এ অভিনয় ও সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে পা রাখেন। এরপর ১৯৫২ সালে নির্মাণ করেন নিজের প্রথম চলচ্চিত্র ‘নাগরিক’, যা পরবর্তীতে ১৯৭৭ সালে মুক্তি পায়।
সেরা চলচ্চিত্রসমূহ:
চলচ্চিত্র | মুক্তির বছর |
---|---|
নাগরিক | ১৯৭৭ |
অযান্ত্রিক | ১৯৫৮ |
মেঘে ঢাকা তারা | ১৯৬০ |
কোমল গান্ধার | ১৯৬১ |
সুবর্ণরেখা | ১৯৬৫ |
তিতাস একটি নদীর নাম | ১৯৭৩ |
যুক্তি তক্কো আর গপ্পো | ১৯৭৭ |

ঋত্বিক ঘটকের অনন্য বৈশিষ্ট্য
১. দেশভাগের যন্ত্রণা: তাঁর সিনেমায় উদ্বাস্তু জীবনের কষ্ট, শোষণ ও মানবিক সংকটের গল্প উঠে এসেছে। ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘সুবর্ণরেখা’ এই বিষয়গুলোর সেরা উদাহরণ।
2. সামাজিক বাস্তবতা: বাস্তবধর্মী গল্প বলার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অগ্রণী।
3. সাহিত্য ও নাটকের প্রভাব: তাঁর চলচ্চিত্রগুলো কাব্যিক ও গভীর সংলাপযুক্ত ছিল।
‘তিতাস একটি নদীর নাম’: বাংলা চলচ্চিত্রের এক অনন্য রত্ন
১৯৭২ সালে বাংলাদেশে এসে তিনি নির্মাণ করেন ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, যা অদ্বৈত মল্লবর্মণের উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি। বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত এই চলচ্চিত্র আজও ক্লাসিক হিসেবে বিবেচিত।
ব্যক্তিগত জীবন ও মৃত্যু
জীবনের শেষ সময়ে অর্থনৈতিক কষ্ট ও মানসিক অসুস্থতায় ভুগতে থাকেন। ১৯৭৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি মাত্র ৫০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
ঋত্বিক ঘটকের প্রভাব ও স্বীকৃতি
- পদ্মশ্রী (১৯৭০) – ভারত সরকারের দেওয়া সম্মান।
- জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৭৪) – ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ সিনেমার জন্য।
- বাংলাদেশ বাচসাস পুরস্কার (১৯৭৪) – ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ চলচ্চিত্রের জন্য।
ঋত্বিক ঘটকের জীবন ও কর্ম বাংলা চলচ্চিত্রকে এক নতুন দিগন্তে পৌঁছে দিয়েছে। তাঁর সিনেমা কেবল বিনোদনের জন্য নয়, বরং সমাজের দুঃখ-দুর্দশা, প্রতিবাদ ও বাস্তবতাকে তুলে ধরার মাধ্যম ছিল। তিনি ছিলেন সিনেমার এক সত্যিকারের বিপ্লবী, যিনি এখনো প্রাসঙ্গিক ও চিরস্মরণীয়।
চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি ঋত্বিক ঘটকের আজ ৪৯তম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা জানাই।