উলটো রথ: ঘরে ফেরার আনন্দ, না কি অভিমানের বাধা?
পুরীর রথযাত্রা হিন্দুধর্মের সবচেয়ে বৃহৎ ও জনপ্রিয় উৎসবগুলির একটি। প্রতি বছর আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে জগন্নাথদেব, বলরাম ও সুভদ্রা রথে চড়ে যাত্রা করেন মাসির বাড়ি—গুন্ডিচা মন্দিরের উদ্দেশে। এই যাত্রাই ‘রথযাত্রা’ নামে পরিচিত।
৮ দিন পরে, আষাঢ় দশমী তিথিতে তিন দেব-দেবী রথে চড়ে ফিরতি পথে রওনা হন — যা ‘উলটো রথ’ বা ‘বহুদা যাত্রা’ নামে পরিচিত। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, নিজের ঘরের দরজায় এসেও তাঁরা প্রবেশ করতে পারেন না!
কে করেন বাধা? কেন ঢুকতে পারেন না জগন্নাথ?
পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, রথে চড়ে যাত্রার সময় জগন্নাথদেব তাঁর স্ত্রী দেবী লক্ষ্মীকে কিছু না জানিয়েই মাসির বাড়ি চলে যান। এই ঘটনায় লক্ষ্মীদেবী প্রবল রুষ্ট হন। স্বামী, দেবতারূপে যাঁর পূজা হয়, তিনি এমন অবজ্ঞা করবেন! তাই রথ ফেরার দিন দেবতারা মন্দিরে ফিরলেও, দেবী লক্ষ্মী দরজা বন্ধ করে দেন। ফলে তিন দেবতা তিনদিন রথেই অবস্থান করতে বাধ্য হন।

এই তিনদিনে কী ঘটে? কোন কোন উৎসব পালিত হয়?
এই তিনদিন শুধু বাধা বা অপেক্ষার নয়—বরং একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ ও চিত্তাকর্ষক উৎসব পালিত হয়, যার প্রত্যেকটি রীতি জগন্নাথ সংস্কৃতির অপরিহার্য অংশ।
১. সুনা বেশ (Suna Besha) — (প্রথম দিন: দশমী)

‘সোনা’র মতো ঝলমলে এই দিনে তিন দেব-দেবীকে সোনার অলঙ্কারে সাজানো হয়।
- পুরাণ অনুসারে, এই দিন চতুর্ভুজ রূপে জগন্নাথদেব ধরা দেন ভক্তদের।
- প্রায় ২০ কেজি সোনা ব্যবহার করা হয় এই সাজে।
- লক্ষ লক্ষ ভক্ত এই “সুনা বেশ” দর্শনের জন্য রথের সামনে ভিড় করেন।
২. অধরপনা উৎসব (Adharapana) — (দ্বিতীয় দিন: একাদশী)
এই উৎসবকে বলা যায় অদৃশ্য আত্মাদের তুষ্ট করার রীতি।
- রথের ওপর বিশাল পাত্রে তৈরি হয় এক বিশেষ পানীয়—অধরপনা। এটি তৈরি হয় দুধ, কলা, চিনি, দারচিনি, এলাচ, তুলসীপাতা ইত্যাদি দিয়ে।
- সন্ধ্যাবেলায় সেই পাত্র ভেঙে রথের সামনে ছড়িয়ে দেওয়া হয়, যাতে ভূত-প্রেত-গন্ধর্ব-যক্ষ প্রভৃতি অদৃশ্য আত্মারা তা পান করতে পারে।
- এই রীতি মানবিক ও অপার্থিব জগতের মিলনের প্রতীক।

৩. রসগোল্লা উৎসব (Rasgulla Utsav) ও নীলাদ্রি বিজয় (Niladri Bije) — (তৃতীয় দিন: দ্বাদশী)

এই দিনেই ঘটে কাহিনির মোড় ঘোরানো পর্ব—লক্ষ্মীদেবীর অভিমান ভাঙানোর দিন।
- জগন্নাথদেব লক্ষ্মীদেবীর মন জিততে তাঁকে রসগোল্লা অর্ঘ্য দেন।
- প্রায় শত শত হাঁড়ি রসগোল্লা ও ৫৬ ভোগ নিবেদন করা হয়।
- লক্ষ্মীদেবী তুষ্ট হলে তবেই মন্দিরের দরজা খোলা হয়।
- তারপর তিন দেবতা রথ থেকে নামিয়ে গর্ভগৃহে প্রতিষ্ঠা করা হয় — এই রীতিই ‘নীলাদ্রি বিজয়’।

এই কাহিনি কেবল পৌরাণিক নয়, এক মানবিক শিক্ষা
দাম্পত্য সম্পর্ক, অভিমান, ক্ষমা ও পুনর্মিলনের মূর্ত রূপ ফুটে ওঠে এই তিনদিনে। দেবতা ও দেবীর মধ্যে সম্পর্কের মাধ্যমে ভক্তদের শেখানো হয় সহনশীলতা, ভালবাসা ও ক্ষমার গুরুত্ব।
পুরীর রথযাত্রা শুধু রথ টানার উৎসব নয়, বরং এক জীবন্ত পৌরাণিক নাট্যরূপ।
উলটো রথের পর দেবী লক্ষ্মীর অভিমান, সুনা বেশের রাজকীয়তা, অধরপনা উৎসবের রহস্যময়তা, আর রসগোল্লার মিষ্টতায় গড়ে ওঠে এক অপূর্ব মেলবন্ধন — যেখানে ভক্তি ও অনুভূতির অপার মিলন ঘটে।