🔱 জগন্নাথের রথযাত্রা: ভক্তি, ইতিহাস, আচার, মিথ ও মহত্বের এক মহোৎসব

প্রতি বছর আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয় তিথিতে ওড়িশার পুরী শহরে পালিত হয় হিন্দু ধর্মের অন্যতম বৃহৎ ও প্রাচীন উৎসব — জগন্নাথদেবের রথযাত্রা। তিন ভাই-বোন, অর্থাৎ জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রা বিশাল রথে চড়ে পুরী শহরের গুণ্ডিচা মন্দিরে গমন করেন। এই উপলক্ষে লক্ষ লক্ষ মানুষ একত্র হন, ধর্ম, জাতি, ভাষা, সীমা—সব কিছু ভুলে ভক্তিতে মিলিত হন।

---

‘জগন্নাথ’ শব্দের তাৎপর্য:

‘জগন্নাথ’ মানে “বিশ্বের অধীশ্বর”। হিন্দু ধর্মে জগন্নাথদেবকে ভগবান বিষ্ণুর অবতার রূপে পূজিত করা হয়। তাঁর সঙ্গে পূজিত হন বড় ভাই বলরাম ও বোন সুভদ্রা। পুরীর জগন্নাথ মন্দির চতুর্দশ ধর্মপীঠ বা চারধাম এর অন্যতম, বাকি তিনটি হল—বদ্রীনাথ, দ্বারকা ও রামেশ্বরম।

---

রথযাত্রার পৌরাণিক কাহিনি:

পুরাণ অনুসারে, একদিন কৃষ্ণের স্ত্রীগণ মাতারোহিণীকে অনুরোধ করেন যাতে তিনি কৃষ্ণ ও গোপীদের লীলা-কথা বলেন। মাতারোহিণী গোপন কথার বর্ণনা দেওয়ার আগে দরজায় সুভদ্রাকে পাহারায় বসান। কিন্তু পরে কৃষ্ণ ও বলরাম এসে সেখানে দাঁড়িয়ে শোনেন। তখন ঋষি নারদ এসে তিন ভাইবোনকে একত্রে দেখে বলেন, “এই রূপেই আমি তোমাদের দর্শন করতে চাই।” সেই থেকেই পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে তিন ভগবান একত্রে বিরাজ করছেন।

---

পুরীর জগন্নাথ মন্দির:

জগন্নাথ মন্দির নির্মিত হয়েছিল ১২তম শতকে গঙ্গা রাজবংশের রাজা অনন্তবর্মণ চোড়গঙ্গ দেবের আমলে। এই মন্দির একাধিক রহস্য ও অলৌকিক ঘটনার জন্যও খ্যাত। যেমন, মন্দিরের ওপর পতাকা সবসময় বাতাসের উলটো দিকে উড়ে, বা মন্দিরের ছায়া দুপুরেও ভূমিতে পড়ে না—এমন অনেক বিশ্বাস মিশে আছে এই দেবতাকে ঘিরে।

---

রথযাত্রার প্রস্তুতি ও কাঠামো:

রথ তৈরির জন্য প্রতি বছর নিদিষ্ট বন থেকে ‘ফলগু কাঠ’ আনা হয়। তিনটি রথের আলাদা নাম ও গঠন রয়েছে:

• নন্দীঘোষ (জগন্নাথের রথ) – ১৬ চাকা
• তালধ্বজ (বলরামের রথ) – ১৪ চাকা
• দর্পদলন (সুভদ্রার রথ) – ১২ চাকা

এই রথগুলি সম্পূর্ণ কাঠ দিয়ে তৈরি হয়, এবং প্রতি বছর নতুন করে গঠন করা হয়।

---

প্রধান আচার ও অনুষ্ঠান:

১. গুণ্ডিচা মার্জনা:

রথযাত্রার আগের দিন গুণ্ডিচা মন্দির পরিষ্কার করা হয়, একে বলা হয় ‘গুণ্ডিচা মার্জনা’। এটি এক প্রকার ভক্তিরূপ।

২. পাহান্ডি বিজয়:

এই রীতিতে দেবতাদের মন্দির থেকে রথে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রথম বলরাম, তারপর সুভদ্রা ও সবশেষে জগন্নাথের বিগ্রহ আনা হয়।

৩. চেরা পাহাড়া:

এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আচার। গজপতি রাজা স্বয়ং সোনার মুড়া দিয়ে রথের চারপাশ ঝাঁট দেন এবং চন্দনের জল ছেটান। এটি সাম্যের প্রতীক—ঈশ্বরের সামনে রাজা ও প্রজার কোনো ভেদ নেই।

৪. হেরা পঞ্চমী:

রথযাত্রার পঞ্চম দিনে লক্ষ্মীদেবী রাগ করে গুণ্ডিচা মন্দিরে যান জগন্নাথের খোঁজে। এর মাধ্যমে স্ত্রী ও স্বামীর সম্পর্কের প্রতীকী রূপায়ণ ঘটে।

৫. রথ প্রত্যাবর্তন:

এই অনুষ্ঠান ‘বহুদা যাত্রা’ নামে পরিচিত। দেবতারা আবার রথে চড়ে মূল মন্দিরে ফিরে আসেন।

---

আধ্যাত্মিক ও জ্যোতিষ গুরুত্ব:

রথযাত্রা শুধুমাত্র উৎসব নয়, এটি আত্মার মুক্তি অর্জনের এক উপায়। বিশ্বাস করা হয়, রথের দড়ি টানলে জন্ম-মৃত্যুর বন্ধন থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। অনেকেই বলেন, “একবার জগন্নাথের রথ টেনেই জীবনের মোক্ষলাভ সম্ভব।”

প্রতি ১২ বছরে একবার ‘নবকলেবর’ হয়, অর্থাৎ দেবতাদের বিগ্রহ পাল্টানো হয় নির্দিষ্ট জ্যোতিষীয় অবস্থানের ভিত্তিতে। এটি খুবই পবিত্র ও বিরল ঘটনা।

---

আন্তর্জাতিক পরিসর ও প্রভাব:

পুরীর রথযাত্রা আজ আন্তর্জাতিক উৎসব। শুধু ভারত নয়, আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া সহ বহু দেশে ISKCON সংগঠনের মাধ্যমে রথযাত্রা পালিত হয়। হাজার হাজার বিদেশি পর্যটক প্রতি বছর পুরী এসে অংশ নেন এই উৎসবে।

---

সাম্য, একতা ও মানবতার উৎসব:

রথযাত্রা এমন এক উৎসব, যেখানে জাতপাত, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। ধনী-গরিব, রাজা-প্রজা—সবাই একসাথে রথ টেনে ঈশ্বরের কাছে মাথা নত করেন। এটি হিন্দু ধর্মের সার্বজনীনতা ও উদারতার প্রতীক।

জগন্নাথের রথযাত্রা আমাদের শেখায় ভক্তি, একতা, বিনয় ও আত্মসমর্পণের মহত্ত্ব। এই উৎসব আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে ঈশ্বর সকলের, তাঁর কাছে সবাই সমান। আসুন, আমরা সকলে মিলে এই মহান রথযাত্রার আনন্দে সামিল হই এবং প্রভু জগন্নাথের আশীর্বাদে জীবনকে পূর্ণতা দিই।

জয় জগন্নাথ 🙏