কামাখ্যার রহস্যময় শক্তিপীঠে শুরু হল আম্বুবাচি
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য অসমের গৌহাটি শহরের উপরে নীলাচল পাহাড়ে অবস্থিত কামাখ্যা মন্দির। হিন্দু ধর্মে ৫১টি শক্তিপীঠের মধ্যে অন্যতম ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই তীর্থস্থানে দেবী দুর্গার যোনিদেশ পতিত হয়েছিল বলে পুরাণে বলা হয়। তাই কামাখ্যা দেবী এখানে উপাসিত হন ‘জননী’রূপে—যিনি সৃষ্টি, কামনা ও শক্তির প্রতীক।

“রজঃস্বলা দেবী”—ধর্মীয় বিশ্বাস ও নারীর ঋতুচক্রের মিলন
আম্বুবাচি উৎসব প্রতি বছর আষাঢ় মাসে তিন রজনী ও এক দিবস অর্থাৎ মোট চারদিন ধরে পালিত হয়। এই সময় বিশ্বাস করা হয় যে মা কামাখ্যা ঋতুমতী বা রজঃস্বলা হন। মানবী নারীর মতোই দেবী নিজেকে ঋতুচক্রে নিয়ে যান, এবং তাই এই চারদিন দেবীর গর্ভগৃহের দরজা বন্ধ রাখা হয়।
এ সময় মন্দিরে কোনও পূজা হয় না, পবিত্র গঙ্গাজল দেওয়া হয় না, কৃষিকাজ বা গৃহস্থ কাজে মাটি খোঁড়া পর্যন্ত বন্ধ থাকে। এই সাময়িক “নিষ্ক্রিয়তা” আসলে এক ধরণের শুদ্ধি ও আত্মজিজ্ঞাসার সময়।

লক্ষাধিক তীর্থযাত্রীর আগমন—তবুও নীরবতা ও উপবাস
মন্দির বন্ধ থাকলেও, তীর্থযাত্রীদের আগমন কমে না। ভারতজুড়ে এবং নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ থেকেও বহু সাধক, সন্ন্যাসী, নারী ও সাধারণ ভক্তেরা এই উৎসবে অংশ নিতে আসেন। নীলাচল পাহাড়ের পাদদেশে তাঁরা উপবাসে থাকেন, তপস্যা করেন, জপতপ করেন। অনেকে এই সময়টিকে নিজেদের পাপক্ষয় ও পূর্ণার্জনের সুযোগ বলে মনে করেন।
মন্দিরের চারপাশে তৈরি হয় অস্থায়ী আশ্রম, সন্ন্যাসীদের ধ্যানস্থলী ও ধর্মচর্চার কেন্দ্র। এই আম্বুবাচি হয়ে ওঠে এক চলমান আধ্যাত্মিক মেলা।

পুনর্জন্মের প্রতীক চতুর্থ দিবস
চতুর্থ দিন দেবীর ‘রজঃশেষ’ হয় এবং পরদিন মন্দিরের দরজা ফের খোলা হয় ভোরবেলা। এই বিশেষ মুহূর্তে ‘দ্বারোদঘাটন’ উপলক্ষে দীর্ঘ লাইন পড়ে ভক্তদের। মেলানির্মিত স্নানঘরে দেবীকে স্নান করানো হয়, নতুন বস্ত্র ও অলংকার পরানো হয়। ভক্তরা তখন পূর্ণদর্শনের সুযোগ পান। এই দিনই দেবীর ‘অর্ঘ্য’ বা প্রসাদ বিতরণ হয়, যা অত্যন্ত পবিত্র বলে বিবেচিত।

ঋতুচক্র নয়, পবিত্রতা—এক সামাজিক বার্তা

আম্বুবাচি কেবল একটি ধর্মীয় আচার নয়, এটি নারী দেহ ও প্রকৃতির পবিত্র ঋতুচক্রের সামাজিক স্বীকৃতিও। এই সময় নারীদেহের ঋতুস্রাবকে ‘অশুচি’ নয়, বরং ‘পবিত্র’ হিসেবে দেখা হয়। মা কামাখ্যার রজঃস্বলা অবস্থাকে পূজনীয় বলে মান্যতা দেওয়ার মধ্য দিয়ে সমাজে এক ইতিবাচক বার্তা যায়—যেখানে নারীর জীবনের স্বাভাবিক জৈবিক পরিবর্তনকেও শ্রদ্ধা করা হয়।