শীত এলেই কলকাতার গন্ধে মিশে থাকে কমলালেবুর টক-মিষ্টি সুবাস, চা-কেকের সঙ্গ, আর পিকনিকের আনন্দ। সময়ের আবহে অনেক কিছু বদলালেও শহরের শীতকালীন মুহূর্তগুলো আজও প্রাণবন্ত। একদিকে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল বা ময়দানের চড়ুইভাতি, অন্যদিকে কর্পোরেট অফিস বা বাড়ির বারান্দায় কফির কাপে আলোচনার দৃশ্য—শীত যেন কলকাতাবাসীর জীবনে বিশেষ এক অধ্যায়।

বাঙালির বেড়ানোর শুরু উনিশ শতকে। তখনকার দিনে তীর্থযাত্রার পাশাপাশি বোটানিক্যাল গার্ডেন, চিড়িয়াখানা, বা জাদুঘরের মতো জায়গায় ঘুরে দেখার চল শুরু হয়। শিক্ষার সঙ্গে আনন্দের মিশেল আনতে শিবনাথ শাস্ত্রী ১৮৮৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘ব্রাহ্ম বালিকা শিক্ষালয়’। এমনকি উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী পশুপাখি, গাছপালা ও পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন সম্পর্কে পড়ুয়াদের জানাতে আগ্রহী ছিলেন।

খেলার কথা বললে, কলকাতার শীত মানেই ফুটবল আর ক্রিকেটের যুগলবন্দি। ১৮০৪ সালে ভারতের প্রথম অফিশিয়াল ক্রিকেট ম্যাচ খেলে ইতিহাস সৃষ্টি করে শহরটি। ইটনিয়ানদের দলের হয়ে রবার্ট ভ্যান্সিটার্ট সেঞ্চুরি করেছিলেন সেই ম্যাচে।

শীতকালীন খাবারদাবারেও বাঙালির উদারতা স্পষ্ট। ফুলকপির সঙ্গে মাছের ঝোল বা বড়দিনে কেকের ঐতিহ্য, সবেতেই মিশে আছে শহরের খাদ্যসংস্কৃতি। তবে সেকালের বাঙালি ডিম দেওয়া কেক খেলেও গঙ্গাজল ছিটিয়ে সংস্কার রক্ষা করত!

শহরের শীতবেলায় আজকাল জিম, মর্নিং ওয়াক বা লাফিং ক্লাবের চল বেড়েছে। অথচ এককালে পাড়ার মাঠ ছিল প্রাণকেন্দ্র। শীতের দিনগুলোয় বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও প্রদর্শনীতে মেতে ওঠে শহর। মোহর-কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শতবর্ষ উদযাপন হোক বা কৃষ্ণা বসুর প্রতিকৃতি প্রদর্শনী—শীতের কলকাতা এক বর্ণময় মঞ্চ।

বাঙালির নাট্যচর্চার সঙ্গেও শীতের যোগাযোগ গভীর। নারী-পরিচালিত নাট্যোৎসব বা ঋতুপর্ণ ঘোষের স্মরণে আয়োজন, সবেতেই সমাজ ও সংস্কৃতির মিশ্রণ স্পষ্ট।
কলকাতার শীত শুধু ঋতু নয়, এক অনুভূতি। এই অনুভূতিতে মিশে থাকে শহরের ইতিহাস, স্মৃতি, আর সংস্কৃতির বুনন।