হাঁটুর ব্যথা এখন অনেকের জন্য বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেটা বয়স চল্লিশ হোক বা আশি, সকলেই এই সমস্যায় ভুগছেন। একটুখানি শুয়ে থাকার পর উঠতে গেলে ব্যথা, বসে থাকার পর দাঁড়াতে গেলে ব্যথা, সিঁড়ি ভাঙার সময় ব্যথা— এমন পরিস্থিতি আজকাল অনেকেই অনুভব করছেন। ঘরে ঘরে এই সমস্যা দেখা যাচ্ছে।
হাঁটুর ব্যথার কারণ
হাঁটুর ব্যথার পেছনে রয়েছে বিভিন্ন কারণ। হাড়ের গঠনে জন্মগত কোনো ত্রুটি, সংক্রমণ, আঘাত, আর্থ্রাইটিস, বা কার্টিলেজের ক্ষতি— সবই হাঁটুর ব্যথার কারণ হতে পারে। আবার কিছু কিছু টিউমারের কারণেও হাঁটুতে ব্যথা হতে পারে।
তবে, বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমানে প্রধান দুটি কারণে হাঁটুর ব্যথা বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রথমত, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস এবং দ্বিতীয়ত, অস্টিয়ো আর্থ্রাইটিস। রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস প্রথমে ছোট ছোট অস্থিসন্ধিতে ক্ষতি করে, পরে হাঁটু, গোড়ালি, কনুই, কাঁধে ব্যথা বাড়তে থাকে।

অন্যদিকে, অস্টিয়ো আর্থ্রাইটিসের প্রধান কারণ হলো বয়সজনিত সমস্যা, যদিও এখন জীবনযাত্রার পরিবর্তন, অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস, এবং শরীরচর্চার অভাবের কারণে ৪০ থেকে ৬০ বছর বয়সীদের মধ্যে এই সমস্যা বাড়ছে।
যৌবনেও হাঁটুর ব্যথা
যারা দীর্ঘক্ষণ কম্পিউটারের সামনে বসে কাজ করেন এবং শরীরচর্চা তেমন করেন না, তাদের মধ্যে হাঁটুর ব্যথা বাড়ছে। এছাড়া গৃহবধূরা, যারা দিনের বেশির ভাগ সময় হাঁটু মুড়ে কাজ করেন, তারাও এই সমস্যায় ভুগছেন।
মহিলাদের মধ্যে হাঁটুর ব্যথা
ভারতে প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ অস্টিয়ো আর্থ্রাইটিসে ভুগছেন এবং তাদের মধ্যে বেশিরভাগই মহিলা। ইস্ট্রোজেন হরমোনের ওঠানামা, যা মহিলাদের শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়াগুলিকে প্রভাবিত করে, ঋতুবন্ধের পর ইস্ট্রোজেন হরমোনের নিঃসরণ কমে যাওয়ার কারণে হাঁটুর ব্যথা বাড়ে। মহিলাদের হাঁটুর গঠনের কারণে বাতের সমস্যা বাড়ে।

পুরুষদের মধ্যে হাঁটুর ব্যথা
পুরুষরাও হাঁটুর ব্যথায় ভুগছেন। বয়সজনিত কারণে হাড়ের ক্ষয়, অবসর সময়ে বাড়িতে বেশি সময় কাটানো, এবং সূর্যের আলো থেকে ভিটামিন ডি না পাওয়া— এগুলোই প্রধান কারণ।

প্রতিস্থাপনের প্রয়োজনীয়তা
হাঁটুর ব্যথা মানেই প্রতিস্থাপন করতে হবে, এমনটা নয়। হাঁটুর ব্যথার তিনটি স্তর রয়েছে— মাইল্ড, মডারেট, এবং সিভিয়ার। মাইল্ড এবং মডারেট স্তরে ব্যায়াম, ওষুধ, ইঞ্জেকশন দিয়ে এই সমস্যা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। সিভিয়ার পর্যায়ে হাঁটুর প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হতে পারে।

বিকল্প চিকিৎসা
১. অল্প ব্যথা হলে নির্দিষ্ট কিছু ব্যায়াম করলে উপকার পাওয়া যায়।
২. ব্যথা কমানোর জন্য হালকা ব্যথানাশক ওষুধ, মলম বা স্প্রে ব্যবহার করা যেতে পারে।
৩. ‘ভিসকো সাপ্লিমেন্টেশন’ নামে একটি জেলির মতো ইঞ্জেকশন দেওয়া যেতে পারে, যা হাঁটুর ব্যথা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।
৪. ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি।
৫. ব্যথা বাড়লে জিমে ভারী ব্যায়াম না করাই ভালো।
৬. মাটিতে বসে কাজ করা, সিঁড়ি ভাঙা, টিভি বা কম্পিউটার দীর্ঘক্ষণ দেখা, এবং সরু হিলের জুতো না পরা উচিত।
অস্ত্রোপচার
যদি পঞ্চাশোর্ধ্ব বা ষাটোর্ধ্ব বয়সে হাঁটুর ব্যথা বাড়তে থাকে, তবে হাঁটু প্রতিস্থাপন প্রয়োজন হতে পারে। ত্রিশ বা চল্লিশ বছর বয়সে আংশিক প্রতিস্থাপন করা হতে পারে।
পথ্য এবং নিয়ম
ব্যথা শুরু হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া এবং রোজকার জীবনযাত্রায় কিছুটা পরিবর্তন আনা জরুরি। সুষম খাদ্যগ্রহণ, নিয়মিত ব্যায়াম, এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখলে হাঁটুর ব্যথা থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে
সুষম খাদ্যগ্রহণের গুরুত্ব
হাঁটুর ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে সুষম খাবার খাওয়া অত্যন্ত জরুরি। পুষ্টিকর খাবার যেমন তাজা শাকসবজি, ফল, বাদাম, এবং দুধজাতীয় খাদ্য হাঁটুর স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। বিশেষ করে ক্যালশিয়াম, ভিটামিন ডি, এবং ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। ক্যালশিয়াম হাড়কে মজবুত করতে সাহায্য করে, ভিটামিন ডি হাড়ের গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, আর ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে।
কোন খাবারগুলি এড়িয়ে চলা উচিত
হাঁটুর ব্যথা কমাতে ভাজাপোড়া ও বেশি তেলযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলা উচিত। অতিরিক্ত মিষ্টি এবং প্রসেসড ফুড হাঁটুর স্বাস্থ্যের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এছাড়া অতিরিক্ত লাল মাংস এবং অ্যালকোহলও এড়িয়ে চলা ভালো, কারণ এগুলো শরীরে প্রদাহ বৃদ্ধি করতে পারে।
জল পানের অভ্যাস
শরীরকে হাইড্রেটেড রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পর্যাপ্ত জল পানের মাধ্যমে শরীরের টক্সিন দূর হয়, যা প্রদাহ কমাতে সহায়ক। দৈনিক অন্তত ৮-১০ গ্লাস জল পান করার পরামর্শ দেওয়া হয়। বিশেষত, যখন শরীরের জলীয় অংশ কমে যায়, তখন হাঁটুর যন্ত্রণা আরও বাড়তে পারে।

নিয়ম:
ওজন নিয়ন্ত্রণ
হাঁটুর ব্যথা কমানোর জন্য ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা অত্যন্ত জরুরি। অতিরিক্ত ওজন হাঁটুর ওপর চাপ সৃষ্টি করে, যা হাঁটুর ব্যথাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। সঠিক ডায়েট এবং নিয়মিত ব্যায়াম মাধ্যমে ওজন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। হাঁটুর উপর চাপ কমাতে, ধীরে ধীরে ওজন কমানোর দিকে মনোযোগ দিতে হবে।
শরীরচর্চা এবং ব্যায়াম
নিয়মিত শরীরচর্চা হাঁটুর হাড় এবং মাংসপেশিকে মজবুত করে। হাঁটুর জন্য হালকা ব্যায়াম, যেমন হাঁটা, সাইক্লিং, এবং সুইমিং অত্যন্ত উপকারী। এগুলি হাঁটুর স্থিতিস্থাপকতা বাড়ায় এবং ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। তবে ভারী ব্যায়াম এড়িয়ে চলা উচিত, কারণ এতে হাঁটুর উপর অতিরিক্ত চাপ পড়তে পারে।
শরীরের সঠিক অবস্থান বজায় রাখা
কাজ করার সময় শরীরের সঠিক অবস্থান বজায় রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘ সময় ধরে বসে থাকা এড়িয়ে চলুন, এবং বসার সময় সঠিকভাবে পা রাখা উচিত। মাটিতে বসে কাজ করা, বার বার সিঁড়ি ভাঙা, বা এক জায়গায় অনেকক্ষণ বসে থাকা— এগুলি হাঁটুর জন্য ক্ষতিকর। এছাড়া, অতিরিক্ত সরু এবং উঁচু হিলের জুতো পরা থেকেও বিরত থাকা উচিত।
প্রতিদিনের জীবনে ছোট ছোট পরিবর্তন
১. মাটিতে বসার পরিবর্তে চেয়ার ব্যবহার করুন।
২. শুয়ে ওঠার সময় পাশে কাত হয়ে ওঠার চেষ্টা করুন।
৩. ঝুঁকে কাজ না করে, দাঁড়িয়ে বা বসে কাজ করার অভ্যাস গড়ে তুলুন।
৪. টিভি বা কম্পিউটার দেখার সময় মাঝে মাঝে উঠে একটু হাঁটাচলা করুন।
৫. অতিরিক্ত ধূমপান এবং মদ্যপান এড়িয়ে চলুন।
এই পথ্য এবং নিয়মগুলি মানলে হাঁটুর ব্যথা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষা করা এবং প্রয়োজনীয় ব্যায়াম করা উচিত।