দুর্গাপুজো ২০২৫ শুরু হতে বাকি !!

Days
Hours
Minutes
Seconds

রবি ঘোষ: স্মৃতির পাতায় অমর হাসির রাজার এক অদম্য জীবনযুদ্ধের গল্প

রবি ঘোষ, বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেতা, যার অভিনয় জীবনের শুরু স্কুল জীবন থেকেই। নাটকে অভিনয়ের প্রতি তাঁর আগ্রহ শুরু হয়েছিল স্কুলে পড়ার সময়, এবং পরে কলেজে ভর্তি হওয়ার পর বন্ধুদের নিয়ে গড়ে তুললেন ‘বন্ধুমন’ নামে একটি নাটকের দল। আশুতোষ কলেজের ছাদে মহড়া দিতেন, তবে তাঁর বাবা, জীতেন্দ্রনাথ, একদমই অভিনয়ে আগ্রহী ছিলেন না। তবে, রবি ঘোষের মন ছিল দৃঢ়, এবং তাঁর অভিনয়ের প্রতি নিবেদন ছিল অটুট। বাবা না চাইলেও, মায়ের সমর্থন তাঁকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করেছিল। তিনি মঞ্চে অভিনয়ের জন্য গভীর রাতে বাড়ি ফিরতেন, যাতে বাবা বুঝতে না পারেন। জীবনের এক পরিহাস, মঞ্চে অভিনয়ের পাঁচ দিন আগে তাঁর বাবা মারা যান। সেসময় তিনি মায়ের কাছে বলেছিলেন, “ছেলের দলের অনেক দেনা-কর্জ রয়েছে, শো বাতিল হলে মুশকিল।” সেই অবস্থাতেই, শোকের মধ্যেও প্রথম মঞ্চাবির্ভাব হয়।

রবি ঘোষ ছিলেন সত্যিকার অর্থে একজন চরিত্রাভিনেতা। মঞ্চে তিনি হাস্যরসাত্মক চরিত্রগুলোতে অভিনয় করতেন, কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন একদম বিপরীত। সারা জীবন অভিনয়ের প্রতি তাঁর নিরলস নিবেদন ছিল, যা তাঁর জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বজায় ছিল। একটি নাটকের শুটিংয়ের জন্য যখন তাঁর ছোট বোন তপতী মারা যান, তখন তিনি গভীর শোকের মধ্যে থেকেও মঞ্চে ‘কনে বিভ্রাট’ নাটকটি অভিনয় করেছিলেন, এবং কেউ ধারণা করতে পারেনি যে, মনের মধ্যে তিনি কী দুঃখ ভরিয়ে রয়েছেন।

অভিনয়ের প্রতি রবি ঘোষের ভালোবাসা এতটাই ছিল যে তিনি সব সময় অভিনয়ের প্রতি নিজেকে আত্মবিশ্বাসী রাখতেন। তাঁর জীবন এক সুস্পষ্ট প্রমাণ, যে কখনোই একটি চরিত্রের বাইরে ভাবেননি। তাঁর প্রিয় অভিনয়ের গুরু ছিলেন চার্লি চ্যাপলিন, যিনি বলেছিলেন, “Actors search for rejection. If they don’t get it they reject themselves.” রবি ঘোষের অভিনয়ও ছিল এক ধরনের জীবনের দর্শন; তিনি নিজের ব্যথা গ্রহণ করে সেটিকে হাস্যরসের মধ্যে রূপান্তরিত করতেন।

রবি ঘোষ প্রথম চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন ১৯৫৯ সালে, ‘আহ্বান’ ছবির মাধ্যমে। তবে তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে যায় তপন সিনহার ‘গল্প হলেও সত্যি’ ছবিতে অভিনয়ের পর। এ ছবিতে তিনি এক চাকরের ভূমিকায় অভিনয় করলেও, মূল চরিত্রে পরিণত হন। রবি ঘোষ তাঁর অভিনয়ের সফর শুরু করেছিলেন চলচ্চিত্রের মহল থেকে, যেখানে তিনি একে একে নানা চরিত্রে সাফল্য অর্জন করেছেন। তিনি সত্যজিৎ রায়ের অভিযান (১৯৬২), মহাপুরুষ (১৯৬৫), অরণ্যের দিনরাত্রি (১৯৭০), হীরক রাজার দেশে (১৯৮০), গুপী বাঘা ফিরে এলো (১৯৯১), এবং আগন্তুক (১৯৯১) ছবিতে অভিনয় করেছেন। এসবের পাশাপাশি তিনি নিধিরাম সর্দার নামে একটি চলচ্চিত্রও পরিচালনা করেন।

১৯৭০ সালে গুপী গাইন বাঘা বাইন ছবিতে অভিনয়ের জন্য তিনি বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে অংশ নেন। গৌতম ঘোষ পরিচালিত পদ্মা নদীর মাঝি ছবিতেও তাঁর অভিনয় সকলের মন জয় করে। এছাড়াও বসন্ত বিলাপ (১৯৭৩), পদি পিসির বার্মি বাক্স (১৯৭২), ধন্যি মেয়ে (১৯৭১), বালিকা বধূ (১৯৬৭), কাল তুমি আলেয়া (১৯৬৬), স্বপ্ন নিয়ে (১৯৬৬), মোমের আলো (১৯৬৪), এবং হাঁসুলীবাঁকের উপকথা (১৯৬২) ছবিগুলোর মতো উল্লেখযোগ্য ছবিতে তিনি অসাধারণ অভিনয় করেছেন। প্রায় অর্ধশতকের অভিনয় জীবনে তিনি একশোর কাছাকাছি ছবিতে কাজ করেছেন এবং বাংলা চলচ্চিত্রে তাঁর অমলিন অবদান চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

রবি ঘোষ বাংলা ছবির ‘কমেডিয়ান’ হিসেবে পরিচিত হলেও, বাস্তবে ছিলেন একজন গম্ভীর, মননশীল মানুষ। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি রামকৃষ্ণ কথামৃত পড়তেন, পরচর্চা পছন্দ করতেন না। প্রথম স্ত্রী অনুভা গুপ্তের মৃত্যুর পর, ১৯৮২ সালে দ্বিতীয় স্ত্রী বৈশাখী দেবীকে বিয়ে করেন। তাঁর জীবনের শেষ সময়টাও অভিনয়ের সঙ্গে ছিল নিবেদিত। ১৯৯৭ সালে তাঁর কৌতুক সংকলন ‘হাসতে যাদের মানা’ প্রকাশিত হয়, এবং সেই বছরেই তিনি প্রয়াত হন।

রবি ঘোষ বাংলা চলচ্চিত্রে তাঁর অভিনয়ের মাধ্যমে শুধু দর্শককে হাসিয়েছেন, তিনি তাঁর চরিত্রাভিনেতা হিসেবে এক অন্য উচ্চতায় পৌঁছেছিলেন। তাঁর অভিনয়ের আন্তরিকতা ও সংবেদনশীলতা, হাস্যরসের মাধ্যমে কঠিন বাস্তবতার উপস্থাপনা, তাঁকে বাংলা চলচ্চিত্রের এক অমূল্য রত্ন করে তুলেছিল। তাঁর অভিনয়ই ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বড় উপহার।

Facebook
Twitter
WhatsApp
Telegram
Email
Print
আরও পড়ুন
error: Content is protected !!