কালীপুজো আসন্ন, আর এই পূজার সাথে শক্তি আরাধনার এক গভীর ইতিহাস জড়িত। বাংলার দুর্গাপূজার যে প্রাচীনত্ব, কালী সাধনার ইতিহাস তার থেকেও বহুগুণ পুরনো। খুঁজলে দেখা যায়, বাংলার বিভিন্ন স্থানে ৭০০-৮০০ বছরের পুরনো কালী পূজার অস্তিত্ব রয়েছে। কলকাতার বুকেও ছড়িয়ে রয়েছে বহু পুরনো কালী মন্দির, যার মধ্যে ঠনঠনিয়া কালী মন্দির অন্যতম। দক্ষিণেশ্বর, কালীঘাট, লেক কালিবাড়ির মতো বিখ্যাত কালী মন্দিরের তালিকায় ঠনঠনিয়া কালী বাড়িও বিশেষ স্থান দখল করে আছে।
ঠনঠনিয়া কালী মন্দিরের প্রতিষ্ঠা
প্রাচীন কাহিনি থেকে জানা যায়, ১৭০৩ সালে সাধক উদয় নারায়ণ ব্রহ্মচারী ঠনঠনিয়া কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। তন্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী উদয় নারায়ণ নিজেই গড়েছিলেন মায়ের মূর্তি, যা আজও সিদ্ধেশ্বরী রূপে পূজিত হন। শুরুর দিকে এই মন্দির ছিল অত্যন্ত ছোট, মাটির দেওয়াল আর তালপাতার ছাউনি দিয়ে তৈরি। তখন এই অঞ্চল ছিল গভীর জঙ্গলে ঘেরা এবং জনবসতি ছিল অল্পই।
শঙ্কর ঘোষের পুনঃনির্মাণ
পরে ১৮০৬ সালে শঙ্কর ঘোষ মন্দিরটি নতুন করে নির্মাণ করেন এবং আজকের মতো মন্দিরের কাঠামো প্রতিষ্ঠিত করেন। কলেজ স্ট্রিটের কাছেই এই মন্দিরের স্থান নির্ধারণ করেন তিনি, এবং আট চালার এক বিশেষ পুষ্পেশ্বর শিব মন্দিরও নির্মাণ করেন। সেবার দায়িত্বও শঙ্কর ঘোষ নিজের কাঁধে তুলে নেন। আজও তাঁর বংশধরেরা এই মন্দিরের সেবায়েত হিসেবে নিয়োজিত আছেন। প্রতি বছর এই মন্দিরে মা কালী’র মূর্তি সংস্কার করা হয় এবং পূর্ণ তান্ত্রিক রীতিতে দেবীর পূজা অনুষ্ঠিত হয়।
দেবীর বিশেষ রূপ ও পূজারীতি
ঠনঠনিয়া কালী মন্দিরে দেবী চতুর্ভুজা এবং গাত্রবর্ণ কালো। বাঁ হাতের দুইটিতে খড়্গ ও নরকপাল, আর ডান হাতের দুটিতে অভয় মুদ্রা ও বরদা মুদ্রা শোভিত। পূজার দিনে মূর্তিটি লাল ও কালো রঙে সজ্জিত করা হয়, এবং সোনা-রুপোর গহনার অলঙ্কারে দেবী সাজে পূজিত হন। যদিও সারা বছর আমিষ ভোগ নিবেদন করা হয়, বিশেষত ফলহারিণী ও দীপান্বিতা কালী পুজোয় ভোগে নিরামিষ পদ থাকে।
রামকৃষ্ণদেবের সঙ্গে সম্পর্কিত স্মৃতি
রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের শৈশবে, তিনি কলকাতায় এসে এই এলাকায় ছিলেন এবং ঠনঠনিয়া কালীবাড়িতে এসে মাতৃ বন্দনায় গাওয়ার অভ্যাস করেছিলেন। তাঁর দেওয়া বিশেষ বাণী, “শঙ্করের হৃদয় মাঝে, কালি বিরাজে” মন্দিরের দেওয়ালে অঙ্কিত আছে আজও। ব্রহ্মানন্দ কেশব চন্দ্র সেনের আরোগ্য কামনায় তিনি এই মন্দিরে এসে ডাব-চিনির নৈবেদ্য দিয়ে পূজো করেছিলেন। যখন তিনি শ্যামপুকুরে অসুস্থ অবস্থায় ছিলেন, তাঁর ভক্তরা আরোগ্য কামনায় ঠনঠনিয়া কালীবাড়িতে পুজো দিয়েছিলেন।
অনন্য তান্ত্রিক রীতির সঙ্গে বিশুদ্ধ বিশ্বাসের এক প্রাচীন মেলবন্ধন হিসেবে ঠনঠনিয়া কালী মন্দির আজও জাগ্রত মাতৃ আরাধনার কেন্দ্র হিসেবে অগণিত ভক্তের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে।