বয়স ৯২ হলেও প্রাণশক্তিতে ভরপুর, কলকাতার কফি হাউসের অন্যতম পুরোনো মুখ অমর মল্লিক। ছেলে দেবপ্রসাদ, নাতি শাক্য, আর নাতির ছেলে কানহাইয়া—চার প্রজন্ম ধরে চলছে তাঁর পরিবার। কিন্তু অমর মল্লিকের গল্প কেবল পরিবারের নয়, বরং তাঁর দীর্ঘ সময় ধরে কফি হাউসে কাটানো স্মৃতির সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছে। সম্প্রতি কফি হাউস কর্তৃপক্ষ তাঁকে ‘প্রবীণতম কফিপ্রেমী’ হিসেবে সম্মানিত করেছে।
অমরবাবু গত একাত্তর বছর ধরে কফি হাউসে আসছেন। উত্তর কলকাতার রতু সরকার লেনের ‘মতিলাল শীলের বাড়ি’ থেকে তাঁর যাত্রা এখনও অব্যাহত। যদিও বয়সের ভারে পা এখন একটু ভারী হয়েছে। ‘‘আগে মাত্র দশ মিনিট হাঁটলেই কফি হাউসে পৌঁছে যেতাম। এখন আধ ঘণ্টা লেগে যায়,’’ বলে হাসি মুখে জানান তিনি।
সুন্দর ছিপছিপে শরীর, মাথার পাকা চুলের মিষ্টি সাদা আভা, দেখে মনেই হয় না তিনি ৯২ বছর পেরিয়ে এসেছেন। কফি হাউসের অগণিত স্মৃতি তাঁর মনের কোণে জমা। ‘‘কতজনের সঙ্গে আড্ডা দিয়েছি, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে মুখোমুখি বসেছি,’’ মনে করে বলেন তিনি। সত্তরের দশকে নকশাল আন্দোলনের দিনগুলোর কথাও তিনি এখনও স্পষ্ট মনে করতে পারেন। ‘‘একদিন কফি হাউসে পুলিশের তাড়া খেয়ে এক ছেলেটি ঢুকেছিল, হাতে ভোজালি নিয়ে। কফি অর্ডার দেওয়ার পর সে ভোজালিটা টেবিলে পোঁতার চেষ্টা করছিল, সঙ্গে সঙ্গেই কাচের টেবিল ভেঙে পড়ল।’’
সেই সময় কফি হাউসে মাত্র দেড় টাকায় এক পট কফি পাওয়া যেত। সঙ্গে একটু দুধ আলাদা করে মিলত।
সেই সময়গুলো এখন অতীত। অমর মল্লিক আজও মোহনবাগানের অন্ধভক্ত। পাড়ার ছোটো ছেলেমেয়েরা তাঁর কাছে স্বাধীনতার গল্প শুনতে চায়। দেশ যখন স্বাধীন হয়, তখন অমরবাবুর বয়স মাত্র পনেরো। ‘‘আমার জ্যাঠতুতো দাদার সঙ্গে তুলা দিয়ে ভারতের মানচিত্র তৈরি করছিলাম। ছাদে পতাকা ওড়ানো হয়েছিল। সে সময়ের আনন্দ আর কোনও কিছুর সঙ্গে তুলনা করা যায় না,’’ অমরবাবুর স্মৃতিচারণ।
তিনি আরও মনে করেন তাঁর ঠাকুরদার মামা স্বামী বিবেকানন্দকে চন্দননগরের বাড়িতে রেখেছিলেন, যখন সমাজ তাঁকে নিয়ে নানা বিতর্কে জড়িয়েছিল। এসব স্মৃতি আজও অমর মল্লিকের জীবনের অংশ।
তবে শুধু আনন্দ নয়, দুঃখের স্মৃতিও তাঁর মনের কোণে রয়ে গেছে। ‘‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুর দিন কেঁদে ফেলেছিলাম। এমন বিশাল শোভাযাত্রা আর কখনও দেখিনি।’’ তাঁর জীবনের আরও একটি অমূল্য অভিজ্ঞতা হল, বাংলার ব্যাডমিন্টন অ্যাসোসিয়েশনের সহকারী সম্পাদক থাকা সময়ে মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সঙ্গে সাক্ষাৎ। সেই সময় এক বিশাল ইলেকট্রিক বিল নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছিলেন। ‘‘জ্যোতিবাবু শুধু বললেন, ‘আচ্ছা, দেখছি’। পরের দিনই চিঠি আসে, বিল দিতে হবে না।’’
এইসব আনন্দ-দুঃখের মুহূর্ত নিয়ে অমর মল্লিক আজও কফি হাউসে আসেন, আড্ডা দেন, আর সময়ের গল্প শোনান।