মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩৯তম প্রেসিডেন্ট এবং বিশ্বব্যাপী শান্তি ও মানবতার প্রতীক, জিমি কার্টার ১০০ বছর বয়সে ২৯ ডিসেম্বর, ২০২৪-এ প্রয়াত হয়েছেন। তিনি ফেব্রুয়ারি ২০২৩ থেকে জর্জিয়ার প্লেইন্সে তার বাড়িতে হসপিস কেয়ারে ছিলেন। পরিবার এবং প্রিয়জনদের ঘিরে তিনি তার জীবনের শেষ দিনগুলি কাটান। তার মৃত্যু এক অসাধারণ জীবনযাত্রার সমাপ্তি ঘটায়, যা জনসেবা, কূটনীতি এবং মানবাধিকারের প্রতি উৎসর্গীকৃত ছিল।
প্রেসিডেন্সিয়াল উত্তরাধিকার (১৯৭৭–১৯৮১)
জিমি কার্টার ১৯৭৭ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রতিনিধিত্বকারী কার্টার তার সময়ে মানবাধিকার, শক্তি নীতি এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতিকে অগ্রাধিকার দেন। তার প্রশাসন বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য অর্জন করেছিল, যার মধ্যে রয়েছে:
- ক্যাম্প ডেভিড অ্যাকর্ডস: ১৯৭৮ সালে, কার্টার মিশর ও ইসরায়েলের মধ্যে ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তি করান, যা মধ্যপ্রাচ্যের কূটনীতিতে একটি যুগান্তকারী ঘটনা।
- ইরান জিম্মি সংকট: তার প্রেসিডেন্সির শেষ বছরে তেহরানে ৫২ জন আমেরিকান কূটনীতিককে ৪৪৪ দিন ধরে জিম্মি রাখা হয়। তাদের মুক্তির জন্য কার্টার নিরলসভাবে কাজ করেন, তবে এটি তার প্রশাসনের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।
- শক্তি নীতি: ১৯৭০-এর দশকের জ্বালানি সংকটের জবাবে কার্টার নবায়নযোগ্য শক্তি এবং সংরক্ষণ প্রচেষ্টাকে উৎসাহিত করেন। তিনি শক্তি দপ্তর প্রতিষ্ঠা করেন এবং বিদেশি তেলের উপর আমেরিকার নির্ভরতা কমানোর ব্যবস্থা নেন।
যদিও কার্টার তার প্রেসিডেন্সিতে রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন, তবে তার নৈতিক শাসন এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতি প্রতিশ্রুতি আমেরিকান রাজনীতিতে একটি দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছিল।
পোস্ট-প্রেসিডেন্সি অবদান
পদত্যাগের পর, কার্টারের মানবিক ও দাতব্য কাজ তার উত্তরাধিকারকে সংজ্ঞায়িত করে। তিনি তার স্ত্রী রোজালিনের সঙ্গে দ্য কার্টার সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন ১৯৮২ সালে। এই প্রতিষ্ঠান বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র উন্নয়ন, জনস্বাস্থ্য উন্নতি এবং সংঘাতের মধ্যস্থতায় কাজ করেছে।
- নোবেল শান্তি পুরস্কার: কার্টার ২০০২ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পান “আন্তর্জাতিক সংঘাতের শান্তিপূর্ণ সমাধান, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের প্রচারে অপ্রতিরোধ্য প্রচেষ্টার জন্য।”
- জনস্বাস্থ্য প্রচার: দ্য কার্টার সেন্টারের মাধ্যমে তিনি গিনি কৃমি রোগ নির্মূলসহ বিভিন্ন রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
ভারতের সাথে সম্পর্ক
কার্টারের সঙ্গে ভারতের একটি বিশেষ সম্পর্ক ছিল। ১৯৭৮ সালে, তিনি হরিয়ানার দৌলতপুর নাসিরাবাদ গ্রামে যান, যা পরবর্তীতে তার সম্মানে কার্টারপুরি নামে পরিচিত হয়। তার মা, লিলিয়ান কার্টার, ১৯৬০-এর দশকে ভারতে পিস কর্পস স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে কাজ করেছিলেন, যা দেশের প্রতি তার সংযোগকে আরও গভীর করে।
ব্যক্তিগত জীবন ও উত্তরাধিকার
কার্টারের জীবন সেবা ও বিশ্বাসের মূল্যবোধে গভীরভাবে প্রোথিত ছিল। তিনি এবং তার স্ত্রী রোজালিন ৭৭ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিবাহিত ছিলেন, যা তাদের মার্কিন প্রেসিডেন্সিয়াল ইতিহাসে দীর্ঘতম দাম্পত্যজীবন করে তুলেছিল। রোজালিন ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে তার আগে মারা যান। তারা একসঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্য, মহিলাদের অধিকার এবং বৈশ্বিক শান্তির পক্ষে কাজ করেছেন।
কার্টার তার সন্তান, নাতি-নাতনি এবং প্রপৌত্রদের রেখে গেছেন। তার প্রয়াণ উপলক্ষে আটলান্টা এবং ওয়াশিংটন, ডি.সি.-তে জনসম্মুখে শ্রদ্ধার অনুষ্ঠান হবে, এবং পরে প্লেইন্স, জর্জিয়াতে একটি ব্যক্তিগত অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠিত হবে।
এদিকে জিমি কার্টারের প্রয়াণে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ব্যারাক ওবামা সহ বহু নেতা শোক জ্ঞাপন করেছেন। জিমি কার্টারের স্বাক্ষরিত তাঁদের একটি ছবি পোস্ট করে ক্যাপশনে বাইডেন লেখেন, ‘৬ দশক ধরে জিমি কার্টারকে বন্ধু বলে ডাকার সৌভাগ্য পেয়েছি জিল এবং আমি। তবে জিমির সবথেকে বড় কৃতিত্ব ছিল, আমেরিকা এবং গোটা বিশ্বে এমন কয়েক লাখ লোক হবে, যাঁরা কখনও জিমির সঙ্গে দেখা করেননি, তাও তাঁরা মনে করতেন জিমি তাঁদের বন্ধু।’
Over six decades, Jill and I had the honor of calling Jimmy Carter a dear friend.
— President Biden (@POTUS) December 29, 2024
But, what’s extraordinary about Jimmy Carter, though, is that millions of people throughout America and the world who never met him thought of him as a dear friend as well. pic.twitter.com/irknhZ6CJY
জিমি কার্টারের মানবাধিকার, শান্তি এবং সহানুভূতির জন্য উৎসর্গীকৃত উত্তরাধিকার বিশ্বজুড়ে প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে। তার প্রেসিডেন্সি এবং পরবর্তী মানবিক কাজের মাধ্যমে তিনি আধুনিক ইতিহাসের অন্যতম শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।